কুরআনের বিনিময়ে মাথার টিউমার অপারেশন !

রাত তখন ১১.৩০ মিনিট। ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হসপিটাল, কাকরাইল। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষমান হাফেজে কুরআন বালকটির স্বজনরা।

সঙ্গে তার ওস্তাদ হাফেজ মাওলানা আহমদুল্লাহ সাহেবও প্রিয় ছাত্রের অপারেশন সাকসেস হবার জন্য দোয়ায় রত আছেন। বাবা মায়ের চোখে পানি।


একবুক ভয় এবং ভরসা নিয়ে প্রিয় সন্তানের গুরুতর অপারেশনটি সফল হবার জন্য মালিকের দরবারে রোনাজারীতে মগ্ন।

এরই মধ্যে সার্জন ডা. মাহফুজুর রহমান স্যার ওটির দরজা খুলে বের হলেন। রাত ১২.১০ মি.। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তখন ২০১৮ সালের প্রথম প্রহর! ডাক্তার বেরিয়ে হাসিমুখে বললেন, আপনাদের প্যাসেন্টের অপারেশন সাকসেস! আলহামদুলিল্লাহ!

বলছি ‘১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতের কথা। যেসময় হাজারো মানুষ হ্যাপি নিউ ইয়ারের নষ্ট সংস্কৃতির চর্চায় লিপ্ত, ঠিক তখনই একটি হাফেজে কুরআন বালককে নিয়ে ঘটছে অসাধারন কোনো ঘটনা।

অপারেশন সফল হবার খবর শুনেও যেন পুরো মাত্রায় খুশি হতে পারছেননা ছেলেটির বাবা মা। অপারেশনের বিল ৬০ হাজার টাকা। খুব বড় অংক না হলেও বালকটির পরিবারের জন্য এটা বিগ বাজেট কেইস। এতো টাকা কোথায় পাবে তারা? সর্বসাকুল্যেও জোগাড় করতে পারেননি এই অংকের পুরোটা।

যদ্দুর পেরেছেন তা নিয়েই প্রিয় পুত্রের অপারেশনের জন্য চলে এসেছেন হসপিটালে। কিন্তু কসাই ডাক্তার কি আর ওসব কথা শোনবে? আমাদের দেশের ডাক্তারদের চরিত্র না জানে কে? রোগী যেন তার কোরবানীর গরু! জবাই করে টাকাটা নিয়েই চম্পট!

সার্জন ডা. মাহফুজুর রহমান বালকটির বাবাকে ডেকে বললেন, অপারেশন তো হয়ে গেছে, এখন আপনারা বিলটা পরিশোধ করেন! আর মনে রাখবেন, আমরা মাত্র ৬০ হাজার টাকায় করে দিলাম কিন্তু এই অপারেশন অন্য কোথাও আপনারা লক্ষ টাকার কমে করাতে পারতেন না!

ছেলেটার বাবা সামান্য মসজিদের ইমাম সাহেব। এই বিলটা থেকেই কিছু কমাবার অনুরোধ করবার ইচ্ছা করছিলেন কিন্তু ডাক্তারের কথার দ্বীতিয় অংশ শুনে তো সেই সাহসটাও হারিয়েছেন। তবুও কাচুমাচু করে বললেন, স্যার, আমি গরীব মানুষ, এই হাফেজে কুরআন ছেলেটার বাবা।

স্যার, আমার বুকের ধন ভয়াবহ টিউমারে আক্রান্ত হয়ে আমার চোখের সামনেই শেষ হয়ে যাবে! এটা তো আমার জন্য সহ্য করা সহজ হবে না! তাই যতটুকু জোগাড় করতে পেরেছি তা নিয়েই চলে এসেছি আপনার কাছে। কিন্তু স্যার, ৬০ হাজার টাকা আমি কই পাবো! স্যার, আপনি একজন পিতা হয়ে আমার ছেলেটার সামনে আমাকে লজ্জা দিয়েন না! স্যার, আমাকে কিছুটা রেহাই দেন স্যার!

ডা. মাহফুজুর রহমান সব শুনলেন দাঁড়িয়ে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন তার অক্ষমতা এবং কলিজার টুকরো সন্তানের জন্য মায়ার বিপুলতা। রাত ১২ টা পেরিয়ে গেছে তখন। এই মধ্য রাতে অপারেশন করবার পর এসব গল্প শোনবার টাইম আছে নাকি! বের করেন টাকা! রাখেন এসব বকওয়াস! এমনই হুংকার দেবার কথা ছিলো কসাই ডাক্তার হিসেবে।

কিন্তু নাহ! তিনি এসব কিছুই বললেন না! তিনি কসাই না! তার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারাটা দয়ার আবেশে নিষ্পাপ ফুলের মত হয়ে গেল। মায়ার পরশে স্থির চোখের কোনে কী যেন চিক চিক করে ওঠলো!

তিনি বলে উঠলেন, আপনার এতটুকু ছেলে হাফেজে কুরআন? জ্বী, স্যার!

কোথায় পড়ছে ও? জামেয়া ইসলামিয়া ফজলুল উলুম মাদরাসায়।

ডাক্তার আর ছেলের বাবার এই কথোপকথন শুনে এগিয়ে এলেন অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার ওস্তাদ।

বললেন, জ্বী, স্যার! ও আমার কাছেই হাফেজ হয়েছে। ভালো ইয়াদ আছে। আসন্ন বোর্ড পরিক্ষায় ওকে নিয়ে আমাদের স্বপ্নও আছে।

ডাক্তার আরো বিগলিত হয়ে গেলেন। আবেগে ফুলে ফুলে উঠছিলেন যেন। বললেন, ধন্য আপনারা! এমন সন্তান আমাদের দেশের গৌরব! এ জাতির গৌরব! আমার সৌভাগ্যের সোপান!

এই বলেই তিনি ছেলেটার বাবার হাত ধরে বললেন, আসুন! আমরা ওর কাছে যাই!

বাবা কিন্তু তখনো কনফিউশানে ভুগছেন। কী হচ্ছে? কিছু ছাড় দেবেনই বা কিনা?

ছেলেটার শিয়রে এসে ডাক্তার বললেন, আব্বু, কেমন বোধ করছ এখন? স্যার, মোটামুটি! ভয় করোনা হ্যা! তুমি দ্রুতই সেরে ওঠবে। ইনশাআল্লাহ। জ্বী, স্যার!

এবার ডা. মাহফুজুর রহমান বললেন, আব্বু, তুমি কি কুরআনের হাফেজ? সমগ্র কুরআন তুমি মুখস্থ করেছ? জ্বী, স্যার!

আচ্ছা, একজন হাফেজে কুরআন কতজন মানুষকে সুপারিশ করে জান্নাতে নিতে পারবে? জানো তুমি? জ্বী স্যার, অন্তত ১০ জনকে নিতে পারবে। আব্বু, তুমি কি আমাকে ওয়াদা দিতে পারো যে, যদি তুমি সেদিন এই বিশেষ ক্ষমতা লাভ করো, তাহলে আমার জন্যও সুপারিশ করবে? ছেলেটা একটু দম নিয়ে বললো, জ্বী স্যার, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ আমাকে এই সুযোগ দিলে আপনার জন্য আমি সুপারিশ করবো!

ডা. মাহফুজুর রহমানের চোখের কোনে চিকচিক করে ওঠলো রূপালী আলো। শিশিরভেজা ঘাসে রোদেলা সকালে যেমন বিভায়িত হয়! তিনি কিছুক্ষণ থেমে থেকে ধরে যাওয়া গলায় বললেন, আব্বু, আমি পবিত্র কুরআনের বিনিময়ে তোমার অপারেশন করে দিলাম! তোমার আব্বুকে এক টাকাও বিল পরিশোধ করতে হবেনা! আমি কুরআন চাই! আমি রোজ হাশরে হাফেজে কুরআনের সুপারিশ চাই!

ছেলেটার বাবা চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। সদ্য অপারেশন হওয়া হাফেজে কুরআন বালকটাও কেঁদে ফেললো। অপারেশনের যন্ত্রনায় না বরং আবেগের তাড়নায়। পরিবেশে এক ভাবাবেগ তৈরি হলো। সহযোগী সার্জন, নার্স সবাই বিস্ময় নিয়ে দেখছিলো, কী হচ্ছে এসব!? ছেলেটার মা তো শাড়ির আঁচলে চোখ মোছতে মোছতে ডাক্তারের জন্য দোয়া করছেন প্রান খুলে।

উৎসঃ আওয়ার ইসলাম